মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ শিশু শংকু সমঝদার

রংপুর, দেশের খবর

ফরহাদুজ্জামান ফারুক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, রংপুর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-29 20:57:47

শংকু সমঝদার। বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম শিশু শহীদ। যার সাহস আর আত্মত্যাগ ভুলে যাবার মতো নয়। যুদ্ধ শুরুর আগেই শংকুর রক্তে রক্তাক্ত রংপুর মুক্তির সংগ্রামে কেঁপে উঠেছিল। শিশু শংকুর অকাল মৃত্যু কাঁদিয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তাইতো ৭ই মার্চের ভাষণে শংকুকে ঘিরে বঙ্গবন্ধুর উচ্চারণে ঠাঁই পায় রংপুর।

সাহসী শংকুরের আত্মদানকে স্মরণ করে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে রংপুরকে জায়গা দিলেও স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও ভালো নেই শংকুর পরিবার। স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম শিশু শহীদের পরিবারটির খোঁজ রাখে না কেউ। অভাব অনটনে দিশেহারা শংকুর মা দীপালি সমঝদারের দিন কাটছে মানবেতরভাবে।

১৯৭১ সালের ৩ মার্চ কারফিউ ভেঙে রংপুরেও হরতাল পালিত হয়। সেই অসহযোগ আন্দোলনে বিক্ষোভ মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন শংকু সমঝদার। বাঙালির সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের ঊষালগ্নে উত্তর জনপদের প্রথম শহীদ ১২ বছরের শিশু শংকু সমঝদার। শুধু তাই নয়, দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে প্রথম শিশু শহীদের নামও শংকু সমঝদার।

একাত্তরের ৩ মার্চের সেই উত্তাল দিনের কথা বলছিলেন প্রবীণ সাংবাদিক মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার গোলাম মোস্তফা বাটুল। তার ভাষ্য মতে, পূর্ব ঘোষিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হওয়ায় কথা থাকলেও হঠাৎ করেই কোন কারণ ছাড়া পাকিস্তানী শাসক প্রধান ইয়াহিয়া খান ১ মার্চ তা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেন। এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানায় ৭০’র নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পাওয়া আওয়ামী লীগসহ সারা বাংলার মানুষ।

২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারাদেশে হরতাল ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তানি দখলদারদের শোষণ-শাসন এবং ষড়যন্ত্রের খপ্পর থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল রংপুরের মানুষ।

বার্তা২৪.কমকে বাটুল বলেন, ‘৩ মার্চ যুবক, ছাত্র, কৃষক, দিন মজুর, নারী পুরুষসহ সর্বস্তরের জনতা শোষক গোষ্ঠীর কারফিউ ভাঙার জন্য রংপুর শহরের কাচারি বাজারে সমবেত হয়েছিল। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী মিছিল বের হয়। মিছিলটি শহরের তেঁতুলতলা (বর্তমান শাপলা চত্বর) এলাকায় আসতেই কলেজ রোড থেকে কারমাইকেল কলেজ ছাত্রদের বিশাল একটি মিছিল এসে যোগ হয় মূল মিছিলের সাথে। কথা ছিল মূল মিছিল তেঁতুলতলা থেকে ফিরে যাবে।

কিন্তু কারমাইকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের চাপে জনস্রোতে ভরে ওঠা মিছিলটি আলমনগর স্টেশনের অবাঙালি বিহারি ক্যাম্পের দিকে এগুতে থাকে। মিছিলটি আলমনগর এলাকার অবাঙালি ব্যবসায়ী সরফরাজ খানের বাসার সামনে (বর্তমান দুদক অফিস) যেতেই মিছিলে থাকা কয়েকজন ঐ বাসার দেয়ালে উর্দুতে লেখা একটি সাইনবোর্ড দেখে তা নামিয়ে ফেলতে উদ্যত হন। মিছিলের সম্মুখভাগে থাকা শংকুও ছুটে যান তাদের সাথে। আর তখনই বাসার ছাদ থেকে মিছিলে গুলিবর্ষণ করা হয়। সেখানে গুলিবিদ্ধ হন ভাইয়ের হাত ধরে মিছিলে আসা স্কুল ছাত্র কিশোর শংকু সমজদার। গুলির বিকট শব্দে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় মিছিল। মাটিয়ে লুটিয়ে পড়া গুলিবিদ্ধ শংকুকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালের দিকে। কিন্তু ততোক্ষণে ইতিহাস রচিত হয়ে গেছে। পথেই মারা যান সাহসী শংকু। ওই মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়েছিল আরেক কিশোর শরিফুল আলম মকবুল। এক মাস পর তাকেও মৃত্যুর কাছে হার মানতে হয়।

এদিকে, শংকুর অকাল মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে ক্ষোভের আগুনে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে পুরো রংপুর। গুলিবিদ্ধ কিশোর শংকুর রক্তাক্ত নিথর দেহ দেখে জনতা উত্তেজিত হয়ে সারা শহরে অবাঙালিদের দোকান ভাঙচুর ও দোকানের সামগ্রী রাস্তায় এনে অগ্নিসংযোগ করতে থাকে। যে বাড়ি থেকে গুলি ছোড়া হয়েছিল সেই বাড়িতে অগ্নিসংযোগের চেষ্টা কালে ইপিআর বাহিনী এসে বাঁধা দান করে।

ওই দিনে আবুল কালাম আজাদ ও ওমর আলী আরও দুইজন নিহত হন অবাঙালীদের হাতে।

শংকু সমঝদারের জীবনদানের ওই মিছিলে ছিলেন নজরুল ইসলাম মৃধা। তিনি তখন সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। নজরুল মৃধা বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘৩ মার্চে শংকু সমঝদারসহ অন্য শহীদদের আত্মদান রংপুরকে মহীয়ান করেছে। পৃথিবীর সেরা ভাষণগুলোর একটি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। সেই ভাষণে শংকুর কারণেই রংপুরের নাম। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ইতিহাস ও আন্তর্জাতিক ঐতিহ্যেরও অংশ। শংকু আর রংপুরও সেই ইতিহাসের সাক্ষী’।

দেখতে দেখতে প্রিয় সন্তান শংকু সমঝদারকে ছাড়াই কেটে গেছে বৃদ্ধা মা দীপালি সমঝদারের আট চল্লিশটি বছর। কেউ খোঁজখবর না নিলেও হয়তো এভাবেই কাটবে বাকি দিনগুলো। বর্তমানে রংপুর মহানগরীর জি.এল রায় রোড কামাল কাছনায় সরকারের দেয়া জীর্ণশীর্ণ বাড়িতে বাস করছেন শংকুর মা শতবর্ষী দীপালি সমঝদার। অসুস্থতা আর অনাহারে-অর্ধাহারে তার দিন কাটছে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় শংকুর নাম গেজেটভুক্ত হলেও ঠিক মতো মিলছে সরকারি ভাতা। বর্তমানে অসুস্থ দীপালি সমঝদার বেসরকারি একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

প্রজন্ম ৭১-এর রংপুর জেলা সভাপতি দেবদাস ঘোষ দেবু বলেন, ‘রংপুরের প্রথম শহীদ শংকুর বৃদ্ধা মা তার বড় ছেলের পরিবারের কাছে আছেন। তারা মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। ছেলের আত্মত্যাগের জন্য কোনও স্বীকৃতি পাননি। এটা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জার। শংকুর পরিবারকে সহায়তা করার জন্য সরকারকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর