উপজেলা চেয়ারম্যানের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ের রহস্য

চাঁদপুর, দেশের খবর

মনিরুজ্জামান বাবলু, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, চাঁদপুর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-23 14:03:14

দেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৭ বছর পর নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক সনদ প্রদর্শন করছেন চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুর রশিদ মজুমদার। এই প্রথম জীবন বৃত্তান্তে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দিলেন তিনি। চাঁদপুরের মুক্তিযোদ্ধা ও এলাকাবাসীরা বলছেন, ‘অধ্যাপক আবদুর রশিদ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা।’

দুই বারের নির্বাচিত উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের হঠাৎ করে মুক্তিযোদ্ধা হবার সখ জাগায়ে এলাকার গেজটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দের মাঝে কৌতূহল বাড়ছে।

অধ্যাপক আবদুর রশিদ দুইবার হাজীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। বর্তমানে তিনি জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য।

অধ্যাপক আবদুর রশিদ আসন্ন উপজেলা নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী। সম্প্রতি তিনি মনোনয়ন চেয়ে সাংবাদিকদের কাছে তার স্বাক্ষরিত দুই পাতার জীবন বৃত্তান্ত দিয়ে পৌঁছে দেন।

সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধের পরে আতাউল গনি ওসমানী হতে যুদ্ধে অংশগ্রহণের স্বীকৃতিস্বরূপ সনদপত্র (নং- ৮৫৫৯৯) গ্রহণ করেন বলে উল্লেখ করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘১৯৯৬ সালে সরকারিভাবে প্রথমে মুক্তিবার্তা তৈরি করা হয়। ঐ সময় আবদুর রশিদ হাজীগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। তারপর তিনি দলের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।’

‘তিনি এতো সময় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেও কেনইবা মুক্তিযুদ্ধের এই সনদ দিয়ে আবেদন করেননি? এটি (আতাউল গণি ওসমানির সনদ ) একজন মুক্তিযোদ্ধার প্রাথমিক সনদ হিসেবে গৃহীত হয়ে থাকে মাত্র।’

মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, ‘আবদুর রশিদ দলীয় ও সরকারী বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তব্যে মুক্তিযোদ্ধা হবার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি তার নানার বাড়ি দোয়ালীয়া গ্রামে সময় কাটান। এসব কথা তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বলেছেন।’

জানা যায়, ২০১৫ সালে সারাদেশে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই ও নতুন আবেদন নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। তখন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে আবেদন করেন অধ্যাপক আবদুর রশিদ। কিন্তু হাজীগঞ্জ উপজেলায় যাছাই-বাছাইয়ের কার্যক্রমটি স্থগিত রয়েছে।

হাজীগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের যুদ্ধকালীন কমান্ডার মজিবুর রহমান বলেন, ‘অধ্যাপক আবদুর রশিদ তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা নন। ধর্মকে দেশে যেভাবে ব্যবহার করে, ঠিক মুক্তিযোদ্ধাও সেভাবে ব্যবহার হয়ে আসছে। একটা সময় আসবে এভাবে আর মুক্তিযোদ্ধা ‘রাফ ইউজ’ করা যাবে না।’

সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবু তাহের বলেন, ‘আমি দায়িত্বে থাকা অবস্থায় অধ্যাপক আবদুর রশিদ উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন। তখন মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেট হয়, মুক্তি বার্তা হয়। ওনি (আবদুর রশিদ) কোনো আবেদন বা ওনার নাম মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোথাও দেখিনি।’

১৯৭১ সালে এই উপজেলা চেয়ারম্যানের সহপাঠি ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা দিলীপ বাবু। তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালের পরীক্ষা ১৯৭২ সালে হয়। ১৯৭২ সালে দুবার মেট্টিক পরীক্ষা হয়। তখন আবদুর রশিদ পরীক্ষা দিয়েছেন। তিনি কোথায়, কখন মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তা আমার জানা নেই।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক আবদুর রশিদ বার্তা২৪কে বলেন,‘জীবন বৃত্তান্তে এর পূর্বে কখনো মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার বিষয়টি দেওয়া হয়নি, এটা সঠিক। ২০১৫ সালে যাচাই-বাছাইয়ের সময় আমি আবেদন করেছি।’

যুদ্ধের সময় কোথায় অবস্থান করেছিলেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি হাজীগঞ্জ উপজেলার নাসিরকোট এলাকায় অবস্থান নিয়েছিলাম।’

১৯৭১ সালে নাসিরকোট এলাকায় বিএফএলের কমান্ডার ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা মোহন সিরাজ। তিনি বার্তা২৪কে বলেন, ‘নাসিরকোট এলাকায় তখন মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং সেন্টার ছিলো। তখন আবদুর রশিদ মজুমদার নামে কেউ ছিল না।’

মুক্তিযুদ্ধে হাজীগঞ্জ উপজেলা এফএফ বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা মজিবুর রহমান। অধ্যাপক আবদুর রশিদ নাসিরকোট এলাকায় যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন কিনা- কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই মুর্হূতে কিছু বলবো না। সময় মতো সব বলবো।’

জীবন বৃত্তান্ত অনুযায়ী, হাজীগঞ্জ পৌরসভার মকিমাবাদ গ্রামের মজুমদার বাড়ির মৃত আ. মতিন মজুমদারের ছেলে অধ্যাপক আবদুর রশিদ মজুমদার। অর্থনীতিতে বিএ ও এমএ ডিগ্রিধারী অধ্যাপক আব্দুর রশিদ ১৯৮০সালে হাজীগঞ্জ ডিগ্রী কলেজে শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন।

২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে অধ্যাপক আবদুর রশিদ দেশের শ্রেষ্ঠ উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে পুরস্কার লাভ করেন। এরপর তিনি ২০১৪ সালে টানা দ্বিতীয় মেয়াদে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন। এর পূর্বে তিনি হাজীগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান হিসেবে দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০০ সালে উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত হন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর