ভেষজের গ্রাম

গাজীপুর, দেশের খবর

ফয়সাল আহমেদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, গাজীপুর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-24 18:34:07

বন-জঙ্গল, মানুষের বাড়ির আঙিনা ঘুরে পরিবারের পুরুষ সদস্যরা ভেষজ গুণসম্পন্ন বিভিন্ন গাছের ছাল, বাকল, পাতা সংগ্রহ করেন আর পরিবারের নারীরা তা প্রক্রিয়াজাত করেন। তারপর সেগুলো বাজারজাত করা হয় দেশের বিভিন্ন ঔষধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে।

প্রকৃতির কাছ থেকে এভাবেই জীবন-জীবিকার সন্ধান পেয়েছেন গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার বরমী ইউনিয়নের দরগারচালা ও ডালেশ্বর গ্রামের শতাধিক পরিবার।

গাজীপুরের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তীয় গ্রামটি ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জের সীমানা সংলগ্ন হওয়ায় ভেজজের চাহিদা জেলা ছাড়িয়ে চারপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে।

ভেষজ সামগ্রী সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণের মাধ্যমে আর্থিক ভাবে সাবলম্বীও হয়ে উঠছেন ডালেশ্বর গ্রামবাসী। আশেপাশের মানুষ এখন ডালেশ্বরকে চেনে ভেষজের গ্রাম হিসাবে।

সরেজমিনে দেখা যায়, ডালেশ্বর গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই ভেষজ উদ্ভিদ প্রক্রিয়াকরণ করা হয়। বাড়ির পুরুষরা এসব সংগ্রহ করেন বন-জঙ্গল ঘুরে। নারীরা সেগুলো কেটে রোদে শুকিয়ে প্রক্রিয়াজাত করেন। তারপর বিক্রি করা হয় স্থানীয় বাজারে ও বিক্রয় কেন্দ্রে।

সেখান থেকে দেশের বিভিন্ন ঔষধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান তা কিনে নিয়ে যায়। ভেষজ পরিবারের সদস্য আরজিনা আক্তারের মতে, ‘নিম, বেলশুট, শাপলা, আমলকি, হরতকি, বহেরা, নিশিন্দা, কালমেঘ, অর্জুন প্রভৃতি গুণ সম্পন্ন দেশজ গানের চাহিদা বেশি।’

গ্রামের প্রবীণ মফিজ উদ্দিনের বয়স আশি ছুয়েছে কিছুদিন হলো। বার্তা২৪.কমকে তিনি জানান, ‘প্রায় ৪০ বছর আগে স্থানীয় ওয়াহেদ আলী কবিরাজের উদ্যোগে এই গ্রামে নানা জাতের ভেষজ উদ্ভিদ সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ ও বাজারজাত করা হত।’

‘পরে তার দ্বারা প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত হয়ে আরো অনেকেই এই পেশায় আসেন। দিনে দিনে ভেষজের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় এ পেশায় লোক বাড়ছে।’

তবে ভেষজ ঔষধ সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকারী বাড়লেও গাছপালার চাষ বাড়ছে না। নতুন নতুন ঔষধী গাছ লাগানোও হচ্ছে না। তদুপরি অসাধুচক্রের কবলে প্রতিনিয়ত উজাড় হচ্ছে বৃহত্তর ভাওয়াল-গাজীপুরের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী বন-জঙ্গল।

ফলে এ পেশার ভবিষ্যত শঙ্কাগ্রস্ত এবং ভেষজ বৃক্ষ সম্পদের পরিমাণ ও সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

স্থানীয় ভেষজ ব্যবসায়ী বুরহান উদ্দিনের মতে, ‘গাজীপুরের বিভিন্ন বনাঞ্চলে আগে প্রচুর ভেষজ উদ্ভিদ সংগ্রহ করা হলেও এখন বনের অস্তিত্ব কমে গেছে। তাই আমরা আশপাশের জেলা হতে তা সংগ্রহ করি। এসব প্রক্রিয়া ও বাজারজাত করে প্রাপ্ত আয়ে ভালভাবেই সংসার চলছে।’

গ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সহায়তায় গড়ে উঠেছে কয়েকটি ‘ভেষজ খলা’ বা ভা-ার। তেমন একটি খলার মালিক আব্দুর রশিদ জানান, ‘তার খলায় প্রায় ২০জন শ্রমিক ভেষজ উদ্ভিদ প্রক্রিয়ার কাজ করেন।’

পাশের দরগারচালা গ্রামের আরিফুল হক বলেন, ‘আমাদের এলাকাটি মূলত কৃষি নির্ভও হলেও কেবল কৃষির সাহায্যে সংসার চালানো কঠিন। এখন কৃষির পাশাপাশি ভেষজ উদ্ভিদের ব্যবসা শুরু করায় সংসারের সচ্ছলতা ফিরছে।’

গাজীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক মাহবুব আলম বলেন, ‘প্রাকৃতিকভাবেই ভেষজ উদ্ভিদের নানা উপকারী গুণাগুণ বিদ্যমান। ভেষজ উদ্ভিদ থেকে নানা ধরনের ঔষধ তৈরি হয়। ফলে আমরা কৃষকদের অব্যবহৃত জায়গায় ভেষজ উদ্ভিদ লাগানোর পরামর্শ দিয়ে থাকি।’

‘ইতোমধ্যেই জেলায় সরকারিভাবে ভেষজ উদ্ভিদের চারা বিতরণ করা হয়েছে। আমরা ভেষজ গুণের বৃক্ষ ও বনাঞ্চল বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’

এ সম্পর্কিত আরও খবর